রাখাইনে গিয়ে যা দেখলেন বাংলাদেশি দুই সাংবাদিক

বাংলাদেশের দু’জন সাংবাদিক মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন৷ ২৫ আগস্টের পর বিদেশি কয়েকজন সাংবাদিক মিয়ানমার সরকারের সহায়তায় রাখাইনে প্রবেশ করেন৷ কিন্তু বাংলাদেশের এই দুই সাংবাদিক রাখাইনে যান নিজের চেষ্টায়৷

মিয়ানমারের রাখাইনে প্রবেশ করা সর্বশেষ বাংলাদেশি সাংবাদিক হলেন সাংবাদিক আমানুর রহমান রনি৷ তিনি বৃহস্পতিবার (২১-০৯-১৭) বিকালের দিকে বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে রাখাইনের তমব্রু এলাকায় প্রবেশ করেন৷ ফিরে আসেন সন্ধ্যার আগেই৷

তিনি সেখানে দুই ঘন্টা অবস্থান করে পাঁচটি পাড়া ঘুরে দেখেন৷ ছবি তোলেন৷ ভিডিও করেন৷ আর ওই পাঁচটি পাড়ায়ই তিনি দেখেছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং মগদের হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র৷ আর তিনি ফিরে আসার ঠিক আগেই ওই এলাকার একটি গ্রামে আগুন দেয়া হয়৷

আমানুর বলেন, ‘এর আগেও আমি রাখাইনে প্রবেশের চেষ্টা করেছি৷ নিরাপত্তার দিক নিশ্চিত না হওয়ায় প্রবেশ করতে পারিনি৷ বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথম দফা চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় আমি সফল হই৷ নির্যাতনের মুখে ঢলের মতো রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে৷ আমি কক্সবাজার থেকে রিপোর্ট করছি৷ ইচ্ছা ছিল নির্যাতনের উৎসমূলে যাওয়ার৷ দেখে আসার৷ কী হয়েছে সেখানে? আমি বান্দরবানের নাইখ্যংছড়ি দিয়ে প্রবেশ করি৷ নো-ম্যান্স ল্যান্ড পার হলেই রাখাইনের তমব্রু৷’

তিনি জানান, ‘কক্সবাজারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ এখনো সুযোগ বুঝে ফেলে আসা ঘরবাড়ি সহায়-সম্পদ দেখতে সেখানে যান৷ আবার ফিরে আসেন৷ আমি সেরকম দু’জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সহায়তায় তমব্রুতে যাই৷ তারা যখন নিশ্চিত করে ওই এলাকায় সেনাবাহিনী ও মগরা নাই, তখনই প্রবেশ করি৷’

– আপনি সেখানে কী দেখলেন?

‘আমি ওপারে গিয়ে যত সামনের দিকে এগিয়েছি ততই ধ্বংসের চিত্র পেয়েছি৷ বাড়িঘরগুলো ভাঙা৷ মাটির দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে৷ আসলে ওই বাড়িগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ বৃষ্টির কারণে ছাই ও আগুনের আলামত ধুয়ে গেছে৷ তাই মনে হয় যেন ঘরবাড়ি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে৷ ঘরগুলোতে লুটপাটের প্রমাণও স্পষ্ট৷ আসবাবপত্র পড়ে আছে৷ ধানের গোলা, কাপড়চোপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে৷’

– এরকম কতগুলো বাড়ি আপনি দেখেছেন?

‘ওখানে গ্রামগুলোকে বলা হয় পাড়া৷ পুরোটা তমব্রু এলাকা৷ আমি পাঁচটি পাড়া দেখার সুযোগ পেয়েছি৷ আমি পাড়াগুলোর প্রায় সব বাড়িই দেখেছি কোনোটির কাদামাটির দেয়াল আছে উপরের কাঠামো নাই৷ আবার কোনোটি পুরোপুরি ভাঙা৷ তবে বাংলাদেশের একদম সীমান্তবর্তী এলাকায় কিছু বাড়িঘর দেখেছি যা অক্ষত আছে৷ আমি দুই কিলোমিটার ভিতরে চলে গিয়েছিলাম৷’

– আপনি কি সেখানে কাউকে পেয়েছেন? কথা বলতে পেরেছেন?

‘আসলে ওই এলাকা এখন বলতে গেলে বিরান৷ কিন্তু যখন সেনাবাহিনী ও মগরা না থাকে তখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া কেউ কেউ সেখানে যান তাদের বাড়িঘর দেখতে৷ হোসেন নামে এরকম একজনকে আমি সেখানে পাই৷ হোসেন আমাকে তার ধ্বংস করে দেয়া বাড়িঘর ঘুরিয়ে দেখান৷ আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এটাতো আমার বাড়ি-ঘর৷ এটা ছেড়ে আমি কোথায় যাব৷ তাই ভয় থাকলেও আসি৷’

আমানুর বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের গ্রামের পরই মগদের গ্রাম আছে৷ সেই গ্রামগুলো অক্ষত আছে৷ কোনো বাড়িঘর পোড়ানো হয়নি৷ আমি দূর থেকে দেখেছি সেখানে এখনো ফসলের মাঠ৷ সেই মাঠে মগরা কাজ করছেন৷ আমি সেখানে থাকতেই মগদের গ্রামের পাশে একটি রোহিঙ্গা গ্রামে আগুন দেয়া হয়৷ সেই গ্রামে নাসিমা খাতুন নামে একজনের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়৷ তাকে আমি সীমান্ত এলকায় এসে বিলাপ করতে দেখেছি৷ তিনি এক পর্যায়ে জ্ঞান হারান৷ সেই আগুনের ঘটনা আমি ভিডিও করেছি৷ এরপর আমি আর নিরাপদ বোধ না করায় দ্রুত বাংলাদেশে চলে আসি৷’

সাংবাদিক আদিল সাখাওয়াত যা বললেন:

ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশি সাংবাদিক আদিল সাখাওয়াত রাখাইনে যান ৭ সেপ্টেম্বর বিকালে৷ তিনি গিয়েছিলেন মংডুর টাউনশিপের মধ্যে শীলখালি ও কুলখালি এলাকায়৷ এলাকা দু’টি একটি ব্রিজ দিয়ে সংযুক্ত৷ ওখানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছিলেন বাংলাদেশে আসার জন্য৷ কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকার উনচিপ্রাং সীমান্ত দিয়ে নৌকায় করে তিনি রাখাইনে প্রবেশ করেন৷

আদিল সাখাওয়াত বলেন, ‘আমি বিকালের দিকে নৌকায় করে শীলখালি ও কুলখালি সংযোগ ব্রিজের কাছে নামি৷ সেখানে নেমে দেখি প্রচুর রোহিঙ্গা নদীর (নাফ) ওই পাড়ে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য৷ সেখানে কাটাতারের বেড়া ধরে, লাইন ধরে রোহিঙ্গারা আসছেন বাংলাদেশে ঢোকার জন্য৷

সেখান থেকে আমি আরো দুই কিলোমিটার ভিতরে যাই৷ যাওয়ার পথে আমার অনেক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয়৷ তাদের কেউ বুদ্ধিডং, কেউ রাখিডং থেকে আসছিলেন৷ যাদের সঙ্গে কথা হয়, তাদের সবাই একই রকম কথা বলেন৷ তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ নির্যাতন করা হয়েছে৷’

– আপনি কি ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে এমন কোনো গ্রাম বা এলাকায় যেতে পেরেছেন?

‘আমি যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রোহিঙ্গারা আমাকে যেতে বারণ করেন৷ আর সেখান থেকেই মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের আউটপোষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷ আমি গেলে ওরা বুঝে ফেলত আমি বাইরে থেকে এসেছি৷ তবে ওখান থেকেই আমি দেখছিলাম দূরে গ্রাম পুড়ছে৷ আর আমার বাঁ দিকে বর্ডার গার্ড পুলিশের একটি বড় আউটপোষ্ট তখন ছিল আরসার দখলে৷’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে কোনো ফটোগ্রাফার ছিলেন না৷ আমি নিজেই মোবাইল দিয়ে ছবি ও ভিডিও ধারণ করি৷ আমি সেখানে দুই ঘন্টা ছিলাম৷ এই সময়ের মধ্যে আমি আমার কাজ করেছি৷’

– আবারো কী রাখাইনে যেতে চান?

‘অবশ্যই যেতে চাই৷ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সবচেয়ে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তুলাতলি নামের একটি গ্রামে৷ সেটি আমি যেখানে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে আরো সাত কিলোমিটার ভিতরে৷ সেখানে অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে৷ স্বজনরা লাশও আনতে পারেননি৷ লাশ পড়ে আছে, পচে গেছে৷

আমি অবৈধভাবে প্রবেশ করেছি বাধ্য হয়ে৷ কোনো উপায় না থাকায় অবৈধভাবেই রোহিঙ্গাদের প্রকৃত নির্যাতনের চিত্র দেখতে গিয়েছি৷ মিয়ানমার সরকারের উচিত বৈধভাবে সাংবাদিকদের সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া৷ আমি তুলাতলি গ্রামে যেতে চাই৷ দেখতে চাই রোহিঙ্গারা যে নির্মমতার কথা বলেছে তা কতটা ভয়াবহ৷’’

সাংবাদিক আমানুর রহমান রনিও আবার যেতে চান মিয়নমারে৷ সরেজমিনে দেখে জানাতে চান মিয়ানমারের রাখাইনের নির্মম ঘটনা৷ তিনি বলেন, ‘বৈধভাবেই যেতে চাই৷ কিন্তু সে পথ বন্ধ থাকলে যে কোনো কৌশল তো সাংবাদিককে নিতেই হবে৷’ – ডয়চে ভেলে।