রাজধানীতে বৃষ্টি এখন অভিশাপ

বৃষ্টি নাকি আশীর্বাদ। বৃষ্টিতেই শান্তির ধারা প্রবাহিত হয় ধরায়। বৃষ্টির তরেই চাতকের অপেক্ষা দিনের পর দিন। কিন্তু সে বৃষ্টিই যেন আজ অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে রাজধানী ঢাকাতে। আকাশে মেঘ দেখলেই কপালে ভাজ পড়ে রাজধানীবাসীর। সামান্য বৃষ্টিতেই থমকে যায় শহর।

আর ভারী বৃষ্টি হলেই হাঁটু থেকে কোমড় পানি। জলজট আর যানজটে একাকার। খানাখন্দে ভরা রাজধানীর সড়কগুলো বৃষ্টিতে আরও অযোগ্য হয়ে পড়ছে দিনে দিনে। বৃষ্টির কারণে রাজধানীর জনজীবন এখন চরম বিপর্যস্ত।

বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রায়ই সব এলাকার প্রধান রাস্তাসহ শাখা রাস্তা, অলিগলি হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়। ড্রেন-ডাস্টবিন, নর্দমার ময়লার সঙ্গে বৃষ্টির পানি মিশে দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। মশার উৎপাত বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু তো আছেই।

বুধবার বিকেলে বৃষ্টিতে সচিবালয়ও পানিবন্ধী হয়ে পড়ে। রাজধানীর অন্যান্য রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ। জলাবদ্ধতায় রাস্তা ডুবে অনেক এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বেশির ভাগ এলাকার রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অনেক স্থানে রাস্তা ও ফুটপাতের ওপর দিয়ে ড্রেনের ময়লা ভেসে ওঠে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার মূল কারণ পুরো রাজধানী জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি আর ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার। এর সঙ্গে কাজের সমন্বয় না থাকাও বড় কারণ।

রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা হাসান আরিফ বলেন, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা, জরাজীর্ণ রাস্তার সংস্কার না হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে চরম জনদুর্ভোগ দেখা দেয়।

আবার একটু বৃষ্টি হলেই রাজধানীর কর্মমুখী মানুষদের গন্তব্যে পৌঁছাতে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সিটিং সার্ভিসে নামে চলাচলকারী অধিকাংশ বাসের গেট থাকে বন্ধ। ফলে বৃষ্টিতে ভিজে ব্যাপক বিড়ম্বনায় পড়েন সাধারণ মানুষ।

বেসরকারি চাকরিজীবী মাহফুজ রহমান বললেন, দীর্ঘক্ষণ বাসের অপেক্ষায় থেকে যখন বাসে উঠতে পারলাম না। তখন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঠিক করতে গিয়ে দেখি আরেক বিস্ময়। বেশিরভাগ অটোরিকশা যেতে রাজি নয়, যারা যেতে চায় তারা ভাড়া চায় দ্বিগুণ। এভাবে কী এই রাজধানীতে বসবাস করা যায়?

শুধু তাই নয়, বৃষ্টিতে অফিস আদালতে আটকে পড়া মানুষগুলোর ময়লা পানির মধ্যেই জামা-কাপড় ভিজিয়ে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হয়। এভাবে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির শিক্ষার্থী, অফিস-আদালতের লোকজনসহ লাখ লাখ নগরবাসী একই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

মিরপুরের বাসিন্দা রহতুল্লাহ বলেন, বৃষ্টি হলেই কাক ভেজা হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে ঘরমুখী মানুষকে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

দেখা যায়, গলিপথের রাস্তাও ময়লা পানিতে একাকার হয়ে যায়। সহজে বোঝার উপায় নেই কোথায় গর্ত আছে আর কোথায় গর্ত নেই। পানির মধ্যে দিয়ে চলতে গিয়ে অনেক গাড়ি, রিকশা, ভ্যান বিকল হচ্ছে, উল্টে ড়িয়ে অনেকে আহত হচ্ছেন।

শুধু তাই নয়, প্রতি বছর জলাবন্ধতা নিরসনে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও নগরবাসী কিছুতেই যেন মুক্তি পাচ্ছে না। এই বিপর্যয়ের জন্য অপরিকল্পিত ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, নগরীর খালগুলো বেদখল হওয়া, অতিমাত্রায় খোঁড়াখুঁড়িকে দায়ী করছেন অনেকে।

আবার অনেকে বলছেন, এটি এক-দু’দিনে হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কার না করা ও ফুটপাতের অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণ এর জন্য দায়ী। বৃষ্টির পানি সেচের জন্য ঢাকা ওয়াসার প্রায় ২৫০টি পাম্প থাকলেও সেগুলো নাকি অধিকাংশ সময়েই অকেজো থাকে। ফলে অতিরিক্ত পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

আর রাজধানীর খালগুলো অনেক আগেই হারিয়েছে। তাই দিনদিন নগরী বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। প্রাকৃতিক খালগুলো উদ্ধারের ব্যবস্থা না করা হলে এই জলাবদ্ধতা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে বলে মনে করছেন নগরবাসী।

নগরবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে পানি নিষ্কাশন মাধ্যমগুলো সঠিকভাবে মেইনটেনেন্স করতে হবে। এই কাজে সমন্বিত পদক্ষেপ করা দরকার। ওয়াসা ও দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকলে কাজের ফল আসবে না। তাছাড়া ড্রেনেজের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন নিতে চায়, সেটা নিলেও দ্রততম সময়ের মধ্যে নেয়া প্রয়োজন।

প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ খালগুলো ভরাট করে ফেলা। এখন বিদ্যমান অবস্থায় টেকসই ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তোলার পাশাপাশি খালগুলো দখল করতে হবে। ভরাটমুক্ত রাখতে হবে ড্রেনেজ সিস্টেম।