ল্যাম্পপোস্টের আলোয় লিখে চলেন একজন আনিসুর

আনিসুর রহমান মোল্লা, অনেকটাই ছিন্নমূল এই ব্যক্তিকে দেখে এখন বোঝার উপায় নেই যে তিনি একসময় পুলিশে চাকরি করেছেন। কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের বিভিন্ন আড়তে সহযোগীর কাজ করা আনিসের দেখা মেলে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বসে খাতায় এঁকে চলেছেন নানা আঁকিবুকি। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে থাকলেও আনিসের এখন জীবন কাটে পথে পথে, রাতে আশ্রয় খোঁজেন বিনা পয়সার কোনো স্থানে।

রাজধানীর শাহবাগে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখা মেলে আনিসের, লেখালেখি দেখে এগিয়ে যেতেই শুদ্ধ ভাষায় শুনালেন জীবনের করুণ গল্প।

৫৯ বছর বয়সী আনিস নরসিংদীর রায়পুরা থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকায় এসে ১৯৭৫ সালে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন। বিভিন্ন জেলায় ১৮ বছর দায়িত্ব পালন শেষে ঢাকায় ফিরে আসেন ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে।

আনিস জানান, প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাকে ট্রাফিক পুলিশে বদলি করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, ১৮ বছরের চাকরি তখন, অনেক সিনিয়র থাকায় আমাকে থানায় ডিউটি দেয়নি। প্রশিক্ষণ না থাকায় যানবাহন সামলানো ছিল কঠিন, রোদ-ঝড়ে ডিউটি করার কষ্ট ছিল। কিন্তু কর্তব্যের খাতিরে আমি সেটি করতে বাধ্য হই।

বাধ্য হয়ে নতুন দায়িত্বে গেলেও নিজেকে মানিয়ে নেন জানিয়ে আনিস বলেন, একসময় কাজটাকে ভালবেসে, নিজের দক্ষতা দিয়ে ভালই কাটছিল। আমি নিজেকে ঢাকায় ট্রাফিকের সেরা দাবি করতাম তখন। সে কারণে আমাকে প্রসিকিউশন সেকশনের অধীনে ওয়ারেন্ট সেকশনে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, আমার কাজ সহকর্মীদের অনেকেরই সহ্য হতো না। তারা আমাকে নানাভাবে ডিস্টার্ব করতো। আমি এসবের প্রতিবাদ করলেও বিচার পেতাম না, তারা আমাকে মেন্টাল (মানসিক রোগী) সাজাতো। একপর্যায়ে আমি মানসিক রোগী হয়ে যাই। দুই বছর অসুস্থ থাকার পর বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে বাধ্য হই, ২৪ বছরের চাকরি জীবন সেখানেই শেষ।

চাকরি ছেড়ে ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠেন বলে জানান তিনি। আনিস বলেন, সুস্থ হওয়ার পর থেকে এখনো আমি চাকরিতে ফিরে যেতে চাই। যদি চাকরিটা ফিরে পেতাম!

শহরের যানজট দেখে খারাপ লাগে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাকে এক সপ্তাহ এর জন্য এই সিটির ট্রাফিকের দায়িত্ব দিলে সরকার সহযোগিতা করলে;, আমার কমেন্ট ফলো করলে এই শহরের যানজট দূর করে দিবো। এটা আমার চ্যালেঞ্জ।

সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই শহরে ঘুরে বেড়ান জানিয়ে আনিস বলেন, সবসময়ই আমি গলায় বাঁশি রাখি। যেখানেই জ্যাম দেখি সেই মোড়েই দাঁড়িয়ে যাই। বাঁশি বাজিয়ে সিগন্যাল দেই, অবসর থাকলে স্বেচ্ছায় ডিউটি করি।

ভালবেসে এ কাজ করলেও এজন্য প্রতিনিয়তই তাকে পড়তে হয় নানা ঝামেলায়। তিনি বলেন, জ্যাম দেখলে ভাল লাগে না। কত কত মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। কিন্তু এটি সরাতে গেলে বাধা আসে। ফুটপাতের দোকানদার আমাকে ব্যঙ্গ করে। কারণ যানজট না থাকলে তাদের লোকসান হয়। যানজট হলে তারা বেশি বিক্রি করতে পারে। সেজন্য তারা আমার উপর চড়াও হয়, এমনকি সুযোগ পেলে আঘাতও করে।

আনিসের স্ত্রী ১ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর রায়েরবাগে থাকে; কিন্তু ২ বছর ধরে তিনি থাকেন কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের বিভিন্ন আড়তে। স্বাধীনভাবে বাঁচতেই এই স্বেচ্ছা নির্বাসন বলে জানিয়েছেন তিনি।

আনিসের ভাষায়, পরিবারের সাথে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। আমি রাত জেগে পড়াশুনা করি। সেসব বইপত্র আমার ওয়াইফ পুড়িয়ে ফেলে, বাজে ব্যবহার করে। রাতে পড়লে বলে, ‘বুড়া বয়সে পইড়া কি করবা?’ নানাভাবে নিরুৎসাহিত হই। সেই মানসিক কষ্ট থেকেই চলে আসছি।

পড়াশুনার বিষয়ে তিনি জানান, পুরনো দিনের নানা ধরণের গান-কবিতা তিনি সংগ্রহ করেন। সেইসব লিখে রাখার পাশাপাশি নিজেও কবিতা-গান লেখার চেষ্টা করেন। প্রতিদিনই সময় করে নিজের দিনলিপিও লিখে রাখেন আনিস।

তবে নিজের কাজে অসন্তুষ্ট আনিস বলেন, আমি মানুষ নিয়ে ভাবি, গান-কবিতা নিয়ে ভাবি; পারিবারিক টেনশন থেকে মুক্ত থাকতে পারলে ভাল লিখতে পারতাম।

রাতে লেখালেখি করার কারণে পরিবার ছাড়া আনিস নতুন ঠিকানায়ও এসব কাজ করতে পারেন না। তাই রাতে অবসর পেলেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় লেখালেখি করেন বলেন জানান তিনি।

আনিস বলেন, কারওয়ান বাজারে বই রাখার নিরাপদ স্থান নেই, চুরি হবে; ফেলে দিবে। তাই ব্যাগ নিয়ে ঘুরি, ব্যাগে সব রাখি।

এরপরও কারওয়ান বাজারে থাকার কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, পরাধীন কোনো চাকরি করতে চাই না আমি। কাজ আমার নেশা। এখানে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারি, কিন্তু সীমিত ইনকাম। সেজন্য কিছু জিনিস হারালেও মাগনা জায়গায় থাকতে বাধ্য হই। আমি একটা সুন্দর জীবন চাই।