লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের

নাজির হোসাইন, পশ্চিম মিয়ানমারের একটি গ্রামের মসজিদের ইমাম। গত মাসে এক সন্ধ্যায় নামাজ শেষে তার আশপাশে আরও অনেকেই সমবেত হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার গ্রাম থেকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) এক ডজনেরও বেশি বিদ্রোহী পাশের একটি পুলিশ পোস্টে হাতে তৈরি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।

এই বিদ্রোহীদের জন্য তাদের নেতার আশীর্বাদ প্রয়োজন। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে তার শেষ কথাগুলো স্মরণ করে নাজির হোসাইন বলেন, ‘একজন ইমাম হিসেবে, আমি উৎসাহ দিয়েছিলাম যেন তারা কখনোই তাদের মিশন থেকে পিছু না হটে।’

‘আমি তাদের বলেছিলাম যে, যদি তারা আমৃত্যু লড়াই না করে, তাহলে সেনাবাহিনী আসবে এবং তাদের পরিবার, নারী ও শিশুদের হত্যা করবে।’

তারা মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত আরসার হাজার হাজার বিদ্রোহীর সঙ্গে ২৫ আগস্টের হামলায় অংশ নেয় এবং হামলার জবাবে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। তখন থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধরা মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘পোড়া-মাটি’ অভিযান শুরু করে। এ অভিযানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। মিয়ানমারের এ অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।

চার বছর আগে ছোট পরিসরে রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধের প্রচেষ্টা শুরু করে আরসা। স্থানীয়ভাবে ‘হারাকাহ আল-ইয়াকিন’ অথবা ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে পরিচিত রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের এ সংগঠন মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর দুটি প্রাণঘাতী হামলা চালায়; এর একটি ছিল গত বছরের অক্টোবরে এবং দ্বিতীয়টি গত মাসে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ অধ্যুষিত একটি দেশে রোহিঙ্গাদের নতুন প্রজন্মের মৌলবাদী এই লড়াই ইতোমধ্যে মিয়ানমারের দারিদ্র্য প্রদেশ রাখাইনের অস্থিতিশীলতা উসকে দিয়েছে।

কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নেয়া নতুন উদ্বেগ যেমন বাড়ছে; তেমনি এর কড়া মাশুল গুণতে হচ্ছে বৃহৎসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে, যারা প্রতিবেশী বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঠাঁই নিয়েছেন। এই শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়তে পারেন। স্থানীয় একটি লড়াই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও মোড় নিতে পারে।

বিদ্রোহী রাজনীতির আরসার প্রচেষ্টা ইতোমধ্যে বিপর্যয় তৈরি করেছে। চলতি মাসে রোহিঙ্গাদের এই সংগঠনটি অস্ত্র বিরতির ঘোষণা দিলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারি ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় রোহিঙ্গারাই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। বিদ্রোহীদের প্রতিরোধের কড়া মাশুল দিতে হচ্ছে তাদের পরিবারকেও।

মিয়ানমারের মংডুর বাসিন্দা নূর আলম বিদ্রোহী এই সংগঠনের সদস্য। সেনাবাহিনী তাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ায় পরিবারসহ এখন আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলে। নূর আলম বলেন, এ লড়াই শুধু আমার কিংবা আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য নয়। এটা হচ্ছে সব রোহিঙ্গার টিকে থাকার লড়াই। যদি আমাদের সন্তানদের শান্তিপূর্ণ বসবাসের ব্যবস্থা করার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতে পারি, তবেই এই লড়াই স্বার্থক হবে।

প্রায় অর্ধ-শতক ধরে মিয়ানমার শাসন করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও তাদের নাগরিক অধিকার বাতিল এবং বর্ণবাদ টিকিয়ে রেখেছে সামরিক বাহিনী। অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন দেশটির বেসামরিক সরকার গত বছরের অক্টোবর থেকে রাখাইনের সহিংসতার ঘটনায় ‘চরমপন্থী বাঙালি সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে।

দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, রাখাইনের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী। ব্যাংককভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ম্যাথিউ স্মিথ বলেন, আমরা কয়েক বছর ধরে মৌলবাদের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেছি। জঙ্গিবাদমূলক কিছু কার্যকলাপ নিয়ে লেখা-লেখিও করেছি।

তিনি বলেন, আমাদের মতে, মৌলবাদ এবং চরমপন্থা মোকাবেলার সর্বোত্তম উপায় হলো রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো; মিয়ানমার সেনাবাহিনী যা করছে তা নয়।

গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তথাকথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে চার লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। সাম্প্রতিক সহিংসতা থেকে পালানোর চেষ্টাকারী রোহিঙ্গা তরুণদেরকে লড়াইয়ে চায় আরসা বিদ্রোহীরা। ২৫ আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর হামলার তথ্য ফাঁস করায় রোহিঙ্গা গুপ্তচরদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে বলে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো জানিয়েছে।

আরসার বিরুদ্ধে রাখাইনের অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু হিন্দু এবং বৌদ্ধদেরকে হত্যার অভিযোগ আছে। মিয়ানমার সরকার বলছে, গত ২৫ আগস্টের হামলার পর থেকে অন্তত এক ডজন হিন্দু নিহত হয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনীর অভিযানে আরো ৩৭০ রোহিঙ্গা বিদ্রোহী মারা গেছে।

সূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস।