শিক্ষিত ও বিত্তবানরাই বেশি সিজারিয়ান করান

প্রসূতি মায়ের কষ্ট, কিছু ক্ষেত্রে সন্তানের স্বাস্থ্য ঝুঁকি আর প্রায় নিশ্চিতভাবেই বেশি খরচের ধাক্কা – এত কিছুর পরও কেন সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান প্রসবের প্রবণতা বাড়ছে? মায়েরাই দিয়েছেন এ সব প্রশ্নের উত্তর।

‘‘আমার কোনো জটিলতা ছিল না বলে ডাক্তারও নিশ্চিত করেছিলেন।

তারপরও আমার ডাক্তার কেন যেন চাইছিলেন না। বারবারই সিজার করতে উৎসাহিত করছিলেন তিনি। তাঁর উৎসাহ দেখেই মনে হচ্ছিল, নরমাল করতে গেলে আবার যদি কোনো জটিলতা হয়। তাই আর ‘রিস্ক’ নেইনি। ” বলছিলেন ঢাকার বেসরকারি একটি টেলিভিশনে কর্মরত এক নারী কর্মী ইপ্সিতা (ছদ্মনাম)।

‘‘মা-খালাদের কাছে শুনেছি সিজার করে সন্তান প্রসব করলে সেই বাচ্চা খুব নাজুক হয়। সারাক্ষণ বেশি বেশি যত্নে রাখতে হয়। কিন্তু নর্মাল ডেলিভারি হলে বাচ্চার নিজের অনেক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। ” যোগ করেন ইপ্সিতা।

শুধু কী এ কারণেই নর্মাল ডেলিভারি চেয়েছিলেন, নাকি অন্য কোনো কারণও ছিল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি যেহেতু চাকুরিজীবী, তাই স্বাভাবিকভাবেই চেয়েছিলাম যত কম সময়ে সম্ভব নিজে ফিট হতে। যেন চার মাসের ছুটি শেষে সময়মতো কাজে যোগ দিতে পারি। নর্মাল ডেলিভারি হলে যত তাড়াতাড়ি প্রসবের রেশ কাটিয়ে ওঠা যায়, সিজারে গেলে তো সেটা সম্ভব নয়। ” এটিও একটি বড় কারণ ছিল নর্মাল ডেলিভারি চাওয়ার।

অস্ত্রোপচারের পরে কি কোনো জটিলতা হয়েছিল বা এখনও হয়? এ প্রশ্নের জবাবে ইপ্সিতা বললেন, ‘‘প্রথম প্রথম তো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই অনেক কষ্ট হতো। মেরুদণ্ড আর তলপেটে ভীষণ ব্যথা অনুভব করতাম। ধীরে ধীরে ব্যথা কমে গেলেও নিজেকে আগের মতো ভাবতে অনেক দিন সময় লেগে গেছে আমার। আর তাছাড়া কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ হঠাৎ পেটে টান লাগতো বলে অবচেতন মনেই এত সাবধান থাকতাম যে নিজেকে আর স্বাভাবিক ভাবতে পারতাম না। ”

বেসরকারি একটি ব্যাংকে কমর্রত সমাপ্তি ইসলাম। সমাপ্তির ক্ষেত্রে অবশ্য শুরু থেকেই ডাক্তার বলেছিলেন নর্মাল ডেলিভারির সম্ভাবনা খুব কম। সিজারের জন্য তৈরি থাকতে। প্রথম সন্তান ডেলিভারির সময় আরিফার বয়স ছিল ৩৫। কাজেই তিনিও ভেবেছিলেন, ‘‘এই বয়সে কোনোভাবেই নর্মাল ডেলিভারি সম্ভব নয়। ”

গর্ভধারণের পুরো সময়টা তেমন একটা শারীরিক সমস্যা না থাকলেও সিজার করে ডেলিভারিটা আরিফার জন্য অলিখিত সিদ্ধান্ত ছিল। তার কোনো নড়চড়ও হয়নি।

অন্যদিকে, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক সাদিয়া নূর। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কারণে সরকারি ছুটির বাইরেও বেশ কিছু ছুটি পেয়েছিলেন তিনি। গর্ভধারণের প্রথম দিকে শারীরিকভাবে খানিকটা দুর্বল থাকায় খুব প্রয়োজন না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি তিনি। পরের দিকে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছিলেন। ‘‘চাইলে নর্মাল ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা করতে পারেন”, বলেছিলেন তার ডাক্তার। কিন্তু তাঁর বেলাতেও ৩৫ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম বলে তিনি নিজেই কোনো ‘রিস্ক’ নিতে চাননি। নিজেদের পারিবারিক ডাক্তারও তেমনটাই পরামর্শ দিয়েছেলন। ফলে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে সিজার করা।

নিশিতা আফরিন নিজেই একজন ডাক্তার। দ্বিতীয় সন্তানের সময় তাঁর কিছুটা জটিলতা থাকলেও প্রথম সন্তানের বেলায় তিনি একেবারে ঠিক ছিলেন। নর্মাল ডেলিভারির দিকেই এগোচ্ছিলেন। ‘লেবার পেইন’-ও শুরু হয়েছিল তাঁর। তারপরও ডাক্তার আগ্রহ দেখানোয় নিশিতা আর ‘না’ করেননি। ভেবেছিলন, প্রথমবার যদি কোনো ঝামেলা হয়।

ছোট ছোট এই ঘটনাগুলো আমাদের আশেপাশের পরিচিতজনদেরই। এ ধরনের কয়েকটি উদাহরণে এই সময়ের মায়েদের সন্তান প্রসবের ধারা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা মেলে। ইদানীং কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা বাড়ায় সন্তান নিতে খানিকটা দেরি করছেন অনেকেই। ফলে প্রথম সন্তানের বেলায় অনেক ক্ষেত্রেই ডাক্তাররা এই ‘বেশি বয়সের’ দোহাই সহজেই সামনে নিয়ে আসেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো ডাক্তারের অতি উৎসাহও নজরে আসে। আজকাল এই প্রবণতা বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। তবে এটিও ঠিক যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তার সাহস দেন না বলে রোগীও সাহস করাকে ‘রিস্ক’ নেয়া মনে করেন। তিনি নিজেই সার্জারি করানোয় বেশি আগ্রহ দেখান।

এক্ষেত্রে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো বেশি এগিয়ে বলে মত দিয়েছেন সবাই।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০১৪ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে গত তিন বছরে ২৩ শতাংশ ডেলিভারি হয়েছে সিজারের মাধ্যমে। বতর্মানে বাংলাদেশে শতকরা ৩৭ ভাগ ডেলিভারি হয়ে থাকে হাসপাতালগুলোতে। যার ২২ ভাগই হয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে।

ওই প্রতিবেদন বলছে, ২০০৪ সালে দেশে সিজারের মাধ্যমে সন্তান হতো ৪ ভাগ, ২০০৭ সালে ৯ ভাগ, ২০১১-তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ ভাগে আর সবশেষ ২০১৭ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৩৫ দশমিক ৫ ভাগে।

বিডিএইচএস-এরই আরেক তথ্য অনুযায়ী, দেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে প্রতি ১০টির মধ্যে ছ’টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে। এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। আর সমাজের শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের শিশুদেরই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জন্ম হচ্ছে এই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।

– ডিডাব্লিউ