শুধু ঢাকাতেই বছরে ভাঙছে ৫১৪৩ সংসার

একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন আরাফাত চৌধুরী। সংসার জীবনে এক কন্যা সন্তানের জনক তিনি। স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন রাজধানীর বনশ্রীর একটি ভাড়া বাড়িতে। সারাদিন অফিসে থাকার কারণে বাসায় একাই থাকতে হচ্ছে স্ত্রী নুসরাত ফারবিনকে। কিন্তু একা একা তার সময় কাটে না। এক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে যুক্ত হন নুসরাত। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় বাড্ডার এক ব্যবসায়ীর ছেলে গোলাম সারোয়ারের সঙ্গে (তিন জনেরই ছদ্মনাম ব্যবহৃত হয়েছে)।

এক পর্যায়ে এই দুই ‘বন্ধুর’ ফেসবুকের কথোপকথন চোখে পড়ে নুসরাতের স্বামী আরাফাত চৌধুরীর। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গিয়ে স্ত্রীর কথায় গড়মিল দেখেন তিনি। এতে সন্দেহের জন্ম নেয়। সংসারে শুরু হয় নানা ঝগড়া-বিবাদ। স্বামী তাকে সন্দেহ করছেন এটা বুঝতে পেরে এক পর্যায়ে ফেসবুক বন্ধু গোলাম সারোয়ারের হাত ধরে পালিয়ে যান নুসরাত। কয়েকদিন পরে আরাফাতের বাসার ঠিকানায় চলে আসে বিবাহ বিচ্ছেদের চিঠি। শুধু আরাফাত-নুসরাতই নয়, কেবল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিবছর পাঁচ হাজার ১৪৩টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।

দুই সিটির তালাক রেজিস্ট্রি দফতর সূত্র জানিয়েছে- দিনদিন ভয়াবহ আকারে বেড়েই চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদ। ঢাকায় এর প্রবণতা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এরমধ্যে নিম্নবৃত্ত থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ও তারকা পরিবারও রয়েছে। বিচ্ছেদের দুই-তৃতীয়াংশ নোটিশই আসছে নারীর কাছ থেকে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১০টি অঞ্চলের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজধানীতে বছরে ৫ হাজার ১৪৩ পরিবারে বিচ্ছেদ ঘটছে। ঢাকা শহরের তুলনায় সারাদেশে এই চিত্র আরও ভয়াবহ।

বিবাহ বিচ্ছেদের নেপথ্যে নানা কারণ দেখছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, যৌতুক দাবি, নির্যাতন, মাদকাসক্ত, সন্দেহপ্রবণতা, একে অপরের অবাধ্য হওয়া, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা, পুরুষ নির্ভরশীলতা কমে যাওয়া, আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি, স্বাধীনচেতা ও শূন্যতা বিরাজ করা, তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার, পরকীয়া ও সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। এছাড়া আধুনিকতার বিষয়ও রয়েছে। তবে স্বাধীনচেতা নারীর জন্য বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখার অবকাশ রয়েছে।

দুই সিটি করপোরেশনের ১০ অঞ্চলের হিসাব মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে রাজধানীতে ৩৬ হাজার ৩৭১টি বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নোটিশ কার্যকর হয়েছে ৩০ হাজার ৮৫৫টি। দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৮০৩টি এবং স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ১৮টি। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি, মাসে ৪২৯টি এবং বছরে পাঁচ হাজার ১৪৩টি সংসার বিচ্ছেদ ঘটছে। এর মধ্যে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেওয়ার পরিমাণ ৬৮ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পরিমাণ ৩৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।

একই সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫টি অঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৭৮৭টি। এর মধ্যে পুরুষের পক্ষ থেকে ৪ হাজার ৯৯৯টি, আর স্ত্রীর পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৮০৩টি। নোটিশ প্রত্যাহার হয়েছে ৩৪৮টি এবং কার্যকর হয়েছে ১৪ হাজার ২৩৪টি।

একই সময়ে উত্তর সিটির ৫টি অঞ্চলে ২০ হাজার ৫৮৪টি তালাকের নোটিশ পড়েছে। এর মধ্যে পুরুষের পক্ষ থেকে ৭ হাজার ১৯টি এবং নারীর পক্ষ থেকে ১৩ হাজার ৪৬৫টি নোটিশ পড়েছে। নোটিশ প্রত্যাহার হয়েছে ৪৬৫টি এবং কার্যকর হয়েছে ১৬ হাজার ৬২১টি। ঠিকানা ঢাকার বাইরে হওয়ায় তিন হাজার ৫১৮টি নোটিশ কার্যকর করা যায়নি।

এ বিষয়ে ডিএসসিসি’র অঞ্চল-২ এর নির্বাহী কর্মকর্তা আবু নঈম বলেন, ‘তালাকের বিষয়টি পর্যালোচনা করে যেটা দেখেছি তা হচ্ছে, তালাকদাতাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নারী। আমার এলাকায় (অঞ্চল-২)বছরে গড়ে পাঁচশ’র বেশি বিচ্ছেদের নোটিশ পড়ছে। তালাকদাতা নারীদের অধিকাংশের বয়স ৩০ বছর থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে ।’

এবিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘তিনটি কারণে তালাক প্রবণতা বাড়ছে। প্রথমত- নারীদের স্বাধীনতা, দ্বিতীয়ত- সচেতনতা এবং তৃতীয়ত- উপার্জন ক্ষমতা বেড়েছে। যে কারণে নারী খুব সহজেই তার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে।’

তিনি বলেন,‘ পৃথিবীতে এমন কোনও সমস্যা নেই, যেটা কোনও সমাজে ঘটে না। তবে মাত্রাগত পার্থক্য আছে। আমাদের দেশে এই সমস্যাটি (বিবাহ বিচ্ছেদ) বেশি ঘটছে। তার মূল কারণ হচ্ছে, অনেক বেশি স্বাধীন চেতা, উপার্জন বাড়া, একে অপরের সঙ্গে খরাপ আচরণ করা। এছাড়া সাংস্কৃতিক , অর্থনৈতিক ও জৈবিক কারণেও বিচ্ছেদ ঘটছে।’ তিনি বলেন, ‘কোনও মানুষই স্বয়ং সম্পূর্ণ না। তার মাঝে কোন না কোনও শূন্যতা বিরাজ করে। তিনি যখন মনে করেন, কারও কাছে গেলে তার এই শূন্যতা দূর হবে, তখন তার দৃষ্টি প্রসারিত হয়।’প্রতিবেদন বাংলা ট্রিবিউনের সৌজন্যে প্রকাশিত।