সন্ধ্যা নামলেই শাহপরীর দ্বীপে রোহিঙ্গার ঢল

সন্ধ্যা নামলেই কক্সবাজারের দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা চর শাহপরীর দ্বীপে রোহিঙ্গার ঢল নামে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু ও তার আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারা সন্ধ্যার পর এসে জড়ো হয় নাফ নদীর তীরে। তারপর সুযোগ বুঝে ডিঙ্গি নৌকা আর ট্রলারে চেপে চলে আসে এপারে, বাংলাদেশে। নাফ নদীর তীরেই নামছে রোহিঙ্গারা। তারপর হেঁটে আসছে শাহপরীর দ্বীপের জেটি ঘাট এলাকায়।

স্থানীয় আলী হোসেন নামে এক ব্যক্তি জানান, ‘গত কয়েকদিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই তিন থেকে পাঁচ হাজার করে রোহিঙ্গা আসছে। এর আগে প্রতিদিন অন্তত হাজার খানেক রোহিঙ্গা আসতো। মংডু শহরের আশেপাশে নতুন করে মগ ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা অত্যাচার শুরু করায় রোহিঙ্গারা শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।’

শাহপরীর দ্বীপে নামার পর ঘাটের স্থানীয় লোকজন রোহিঙ্গাদের হাতে টুকটাক খাবার তুলে দিচ্ছেন। তা হাতে নিয়ে রোহিঙ্গারা স্থানীয় বড় মাদ্রাসায় চলে যায়। সেখানে রাত কাটানোর ব্যবস্থাও হয়ে যাচ্ছে তাদের। সকালে উঠে ভাঙ্গা মাথা এলাকার খাল পেরিয়ে তারা চলে যাচ্ছে সাবরাং, সেনাবাহিনীর ত্রাণ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে। সেখানে প্রাথমিকভাবে নাম নিবন্ধনের পর রোহিঙ্গাদের তুলে দেওয়া হয় ট্রাকে। পরের গন্তব্য টেকনাফ থেকে উখিয়া সড়কের আশেপাশের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) শাহপরীর দ্বীপে দিনভর অবস্থান করে এ চিত্রই দেখা গেছে।

এ ব্যাপারে শাহপরীর দ্বীপে দায়িত্বরত বিজিবি’র কর্মকর্তারা বলছেন, মাঝখানে বন্ধ থাকার পর গত কয়েকদিন ধরে রোহিঙ্গারা বেশি আসছে। রাত নামলেই রোহিঙ্গাদের ঢল নামছে। মানবিক কারণে তাদের অনুপ্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। তবে রোহিঙ্গারা যাতে কোনওভাবেই ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য তারা নদী তীরের সড়কে ওঠার পরপরই সোজা বড় মাদ্রাসার মাঠে চলে যেতে বলা হয়।

শুক্রবার সকালে টেকনাফ থেকে নয়াপাড়া সাবরাং হয়ে শাহপরীর দ্বীপে যাওয়ার সময় দেখা যায় রাস্তার দু’পাশে অনেক রোহিঙ্গা বসে আছে। কেউ স্বজনদের অপেক্ষায়, কেউবা ত্রাণের আশায়। মাথা ভাঙ্গা এলাকাতেও সারি বেঁধে ছোট ছোট বস্তা বা ব্যাগে করে শেষ সম্বলটুকু নিয়ে হাঁটতে দেখা যায় তাদের। সেসময় কথা হয় তাদের অনেকের সঙ্গেই। মিয়ানমারের মংডু খালপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াস জানান, তার পরিবারের সদস্যরা আগেই এসেছে এপারে (বাংলাদেশে)। নৌকা ভাড়ার অভাবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আসতে পারেননি তিনি। তবে মংডুর মুন্নিপাড়ার ঘাট থেকে মানুষের কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে কিছু মিয়ানমারের টাকা জোগাড় করে শুক্রবার নৌকায় নাফ নদী পার হতে পেরেছেন তিনি। সঙ্গে টাকা কম থাকায় ডিঙ্গি নৌকার মাঝির সঙ্গে দাঁড় টেনে সহযোগিতাও করতে হয়েছে।

ইলিয়াস আরও বলেন, ‘এখনো ওপারে মগ-সেনারা আগের মতোই তাণ্ডব চালাচ্ছে। কারো বাড়িতে আগুন দিচ্ছে তো কারো বাড়ি ভেঙে দিচ্ছে। ভয়ে কেউ বাড়িতে থাকতে পারে না।’ দশ দিন আগে তার বাড়িতে মগ ও সেনারা আগুন দেয় বলেও জানান তিনি। এরপর থেকে বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে পালিয়ে দিন কাটিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে শাহপরীর দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ‘মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা নৌকাগুলো এসে ভিড়ছে জেটি ঘাটের উত্তরে বরফকল এলাকা; পশ্চিম বাজারপাড়া জালিয়াপাড়া আর জেটি ঘাটের দক্ষিণে বর্মা পাড়া, মিস্ত্রি পাড়া, দক্ষিণ পাড়া ও গুলা পাড়া এলাকায়। সেখান থেকে রোহিঙ্গারা এসে জড়ো হয় শাহপরীর দ্বীপের বড় মাদ্রাসায়।’

সরেজমিন শুক্রবার মাগরিবের নামাজের পরপরই শাহপরীর দ্বীপের জেটি ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উত্তর ও দক্ষিণের দুই রাস্তা দিয়েই সারি বেঁধে রোহিঙ্গারা আসছে। তাদের প্রায় সবারই ভাষ্য, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে মগরা। এর আগে লুট করেছে ধন-সম্পদ। বেশিরভাগই বাড়ি ছেড়েছেন এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন আগে। আশেপাশের মুসলিম পাড়াগুলোতে আত্মগোপনে থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছেছেন। তারপর নৌকায় করে চলে এসেছেন এপারে। নিজের পরিবারের পাঁচ সদস্যসহ তিন পরিবারের মোট ১৬ সদস্য নিয়ে আসা মংডুর নাটেরবিল এলাকার ইমাম হোসেন জানান, তিন দিন আগে তার দোতলা বাড়িতে আগুন দিয়েছে মগরা। তিন দিন তিনি পরিবার নিয়ে পালিয়ে ছিলেন। শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে সবাইকে নিয়ে ঘাটে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ির আশেপাশের ইটালিয়া, রেক্ষুয়াং, সুহিদাপাড়া, সিদ্ধিপাড়াসহ মোট ৯টি পাড়া রয়েছে। এগুলো সব এখন জনশূন্য। সব বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে মগ ও সেনারা।’

ইমাম হোসেনের সঙ্গে আসা ইটালিয়া পাড়ার দ্বীন মোহাম্মদ জানান, তিনি স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে চার দিন আগে বাসা থেকে বের হয়েছেন। মংডু থেকে তার বাড়ি প্রায় ২০ মাইল দূরে। পাহাড়ি পথে লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি নদীর তীরে এসে জেলে নৌকার মাধ্যমে নাফ নদী পার হয়েছেন। দ্বীন মোহাম্মদ আরও বলেন, সহায়-সম্পদ সব গেছে। এখন কোনও রকমে জানটা হাতে নিয়ে এসেছেন। বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে তা সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘এখন শত কষ্ট হলেও জীবনটা তো আর হারাতে হবে না। ওপারে থাকলে মগের হাতে মরতে হতো নিশ্চিত।’

উল্লেখ্য,গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে হামলাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনী ও মগরা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ছয় থেকে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার-টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। যাদের বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ।