সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় নেওয়ার প্রস্তাব ইউনেসকোর

সরকার রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নেয়নি, বাতিল করেনি সুন্দরবনের চারপাশের শিল্প কারখানাগুলোর অনুমোদনও। এই পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান বাতিল করে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছে জাতিসংঘের ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র।

গত শুক্রবার বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ২১ সদস্যের কমিটি এই প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। আগামী ২ থেকে ১২ জুলাই পোল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় সংস্থাটির বার্ষিক সাধারণ সভায় এই প্রস্তাব বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে। সংস্থাটি বলছে, সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশকে করা তাদের ১০টি সুপারিশের মধ্যে ৮টিই বাস্তবায়িত হয়নি। সরকার কেবল সুন্দরবনের পাশে ওরিয়ন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অনুমোদন দেয়নি এবং রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় বাতিল করা হয়েছে বলে ইউনেসকোকে জানিয়েছে।

এর আগেও রামপাল প্রকল্প বাতিলের জন্য ইউনেসকো ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে তিন দফায় সরকারকে সুপারিশ করেছিল। সর্বশেষ গত বছর মার্চে সংস্থাটির একটি পর্যবেক্ষক দল সুন্দরবন সফর করে। তারা এই প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে বলে মত দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের। আমরা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এবং বেশ কিছু শর্ত পালন সাপেক্ষে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের অনুমতি পেয়েছি। আমরা যদি কোনো শর্ত ভঙ্গ করি, তাহলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় তা দেখবে। সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য থাকবে কি থাকবে না, তা ওই মন্ত্রণালয় দেখবে। রামপাল প্রকল্পের কারণে যে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না, সে বিষয়ে আমরা ইউনেসকোর কাছে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরব।’

জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইউনেসকোর এই কঠোর অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্যারিসে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে যাচ্ছে। সোমবার সরকারি এ প্রতিনিধিদলটির সঙ্গে ইউনেসকোর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। মূলত সুন্দরবনের নাম যাতে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ না যায়, সে জন্য তারা ইউনেসকোর কাছে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরবে।

অবশ্য রামপাল প্রকল্পের বিষয়ে এখনো পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা বেশ কিছু শর্তে রামপাল প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র ও পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) অনুমোদন দিয়েছি। আমরা আশা করি, ইউনেসকো আমাদের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে পেরে সন্তুষ্ট হবে।’

গত শুক্রবার ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে ৯৯টি বিশ্ব ঐতিহ্যবিষয়ক ১৯৯ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে সুন্দরবন নিয়ে তাদের অবস্থান ও সুপারিশ সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে সংস্থাটি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) ছাড়া সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া পশুর নদ খনন না করা, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ করা, সুন্দরবন ঘিরে নির্মিত শিল্পকারখানা ও নির্মাণাধীন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সেখানে কী ক্ষতি হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষক দল গঠন করতে বলেছে। তাদের দিয়ে সুন্দরবনে এর প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলেছে।

এ বিষয়ে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি বিষয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বমানের আটটি গবেষণা প্রতিবেদন সবার উদ্দেশে তুলে ধরেছি। তারপরও রামপাল প্রকল্প নিয়ে সরকার যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে এই বন চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান অটুট থাকুক। এখনো সময় আছে, সরকার এই প্রকল্প থেকে সরে আসুক।’

ইউনেসকোর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রামপাল প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের অসাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এই আশঙ্কার পক্ষে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার পরও সরকার প্রকল্পটি বাতিল করেনি। ২০১৪ সালে সুন্দরবনের তেলবাহী ট্যাংকারডুবির পর আরও তিনটি কয়লা ও সিমেন্টবাহী জাহাজডুবি হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, তার কোনো প্রভাব সমীক্ষা করেনি সরকার।

উল্লেখ্য, গত বছরের মার্চে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি দল প্যারিসে ইউনেসকো সদর দপ্তরে যায়। দলটি সংস্থাটির বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগ তুলে ধরে। একই সঙ্গে তারা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না—এমন যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে।
ওই প্রতিনিধিদল দেশে ফেরার পরপরই ইউনেসকো থেকে ওই সফর বিষয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। তাতে তারা বলে, রামপাল প্রকল্প বাতিলের সুপারিশের ব্যাপারে তারা অটল আছে।

প্যারিসের উদ্দেশে রওনা হওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আগামী সোমবার ইউনেসকোর সঙ্গে আমাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। শুধু রামপাল প্রকল্প নয়, পুরো সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার কী কাজ করছে, তা আমরা ইউনেসকোর কাছে তুলে ধরব।’

ইউনেসকোর সুপারিশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, রামপাল প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি বিষয়ে প্রথমে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা মতামত তুলে ধরেছিলেন। তারপর বিশ্ববাসী ওই বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে একমত হয়ে মতামত দিয়েছেন। ইউনেসকো এখন যে কথাগুলো বলছে, তা সুন্দরবন রক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের মতামতকে প্রতিনিধিত্ব করছে। আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, একটি মাত্র প্রকল্প নিয়ে সরকারের একগুঁয়েমির কারণে সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাতে চলেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় তৈরি করবে। সরকার নিজে অসামান্য এই বন ধ্বংস করতে যাচ্ছে।খবর প্রথম আলো’র।