সেদিন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল হলি আর্টিজানের জিম্মিরা

দিনটি ছিল শুক্রবার। রাত সাড়ে আটটার দিকে হঠাৎ করেই গুলশান-২ এর হলি আর্টিজান বেকারি নামের স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে অস্ত্রধারী ৫ জঙ্গি, যাদের বয়স ২২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। তারা রেস্টুরেন্টের সবাইকে জিম্মি ঘোষণা করে। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান শুরু করে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে সেখানে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন নিহত এবং ৫০ জনেরও বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আহত হন।

এরপরের ঘটনা পুরোটাই রক্তাক্ত, জঙ্গিরা একে একে ২০ জন জিম্মিকে নিষ্ঠুরভাবে জবাই করে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি, একজন ভারতীয়, ৯ ইতালীয় এবং সাতজন জাপানি নাগরিক। প্রায় ১২ ঘন্টার ওই ‘জিম্মি সংকট’ শেষ হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ দিয়ে। অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। নিহত জঙ্গিরা হলেন- নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জল ওরফে বিকাশ।পরে আক্রান্ত রেস্টুরেন্ট থেকে উদ্ধার করা হয় হাসনাত করিম, তাহমিদ খানসহ ৩২ জিম্মিকে।

পরবর্তীতে জানা যায়, হলি আর্টিজানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই এলোপাথারি গুলি করতে থাকে জঙ্গিরা। একই সঙ্গে ধারালো অস্ত্র দিয়ে দেশি বিদেশি নাগরিকদের কোপাতে থাকে। প্রথম ধাক্কায় একদিকে ইতালিয়ান আরেক দিকে জাপানিদের উপর হামলা চালানো হয়। এ সময় কেউ কেউ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু একে একে সব বিদেশি নাগরিককে হত্যা করে জঙ্গিরা।

যাদের হত্যা করা হয়:

জঙ্গিদের নৃশংসতায় যে ২০ জিম্মি প্রাণ হারান তাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন বাংলাদেশি। তারা হলেন- শিল্প ব্যক্তিত্ব ইশরাত আখন্দ, ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তরুণী অবিন্তা কবির।

এছাড়া ওই হামলায় ৯ জন ইতালীয় নাগরিক নিহত হন। তারা হলেন- স্টুডিওটেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদিয়া বেনডিট্টি, ক্লদিও ক্যাপেলি, ভিনসেনজো ডি অ্যালেস্ট্রো, ফেডো ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্লদিও মারিয়া ডি অ্যান্টোনা, অন্তঃসত্ত্বা সিমেনা মন্টি, অ্যাডেল পুলগিসি, ক্রিস্টিয়ান রসি, মারিয়া রিবোলি ও মার্কো টোনডাটে।

হলি আর্টিজানের ওই হামলায় তারিশি জৈন নামে এক ভারতীয় নাগরিকও নিহত হন। ভয়াবহ ওই হামলায় দুই নারীসহ সাতজন জাপানি নাগরিক নিহত হন, যাদের মধ্যে ছয়জনই মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। নিহতরা হলেন- হাসিমাতো হিদোকি, কোসো ওগাসাওয়ারা, মাকোতো ওকামুরা, হিরোশি তানাকা, ইয়াকো সাকাই, নবুহিরো ফুরোসাকি ও রুই শিমোগদারিয়া।

যেভাবে জিম্মিদের হত্যা করে জঙ্গিরা:

বাংলাদেশি তরুণী ইশরাত আখন্দকে মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। এক জাপানি নাগরিককে কোল্ডরুম থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করা হয়। ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈন হামলার পরপরই বাথরুমে আত্মগোপন করেন। কিন্তু সেখান থেকে বের করে এনে তাদের হত্যা করা হয়।

নিহতদের ময়নাতদন্তকারী ফরেনসিক বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ফারাজের শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। তারিশির মাথায় গুলির চিহ্ন ও শরীরে অন্তত ৪০টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

আর অবিন্তাকে গলা কেটে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। হলি আর্টিজানে নিহত ২০ জিম্মির ময়নাতদন্তের সময় মোট নয়জনের শরীরে ১০টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাদের সবার শরীরে একটি করে এবং বিদেশি এক নাগরিকের শরীরে দুটি গুলির চিহ্ন ছিল। নিহত দেশি বিদেশি নাগরিকদের পেছন থেকে ঘাড়ে ও মাথার পেছনে গুলি করা হয়। তাদের প্রত্যেকের শরীরে ছিল ধারালো অস্ত্রের আঘাত।

ইতালিয়ান নাগরিক নাদিয়া বেনডিট্টির হাত, মাথা ও ঘাড়ে একাধিক ছুরিকাঘাত ছিল। সিমেনা মন্টির মাথার পেছনে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। ক্লদিও ক্যাপেলির মাথার পেছনে বুলেটের চিহ্ন পাওয়া যায়। এছাড়া ক্লদিও ডি অ্যান্টোনার শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাত ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল।। মার্কো টোনডাটের মাথায় গুলি, ক্রিস্টিয়ান রসির শরীরে গুলি ও মাথায়, ঘাড়ে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। অ্যাডেল পুলগিসির ঘাড়ে ও মাথার পেছনে একাধিক ছুরিকাঘাত ছিল। ভিনসেনজো ডি অ্যালেস্ট্রোর মাথায় বুলেট ও মারিয়া রিবোলির মাথায় দুটি গুলি বিদ্ধ হয়েছিল।

অপরদিকে জাপানি নাগরিকদের মধ্যে হাসিমাতো হিদোকির মাথায় ও ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাত, কোসো ওগাসাওয়ারার পেটে গুলিবিদ্ধ হয়। মাকোতো ওকামুরার মাথায় গুলিবিদ্ধ ও হিরোশি তানাকার শরীরে একাধিক ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। ইয়াকো সাকাইয়ের মাথায় ভারি বস্তু দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। নবুহিরো ফুরোসাকির শরীরের বিভিন্ন অংশে চারটি গুলিবিদ্ধ হয়েছিল ও রুই শিমোগদারিয়ার ঘাড়ে ছুরিকাঘাত ছিল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, নারীদের উপর বেশি নৃশংস ছিল হামলাকারীরা। নারীদের বুকে, পেটে ও হাতে বেশি ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় নাগরিক তারিশি জৈনের শরীরে ৪০টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। হত্যাকাণ্ডের ধরণ দেখে মনে হয়েছে জঙ্গিরা অনেক বেশি নির্মম ছিল।-পরিবর্তন