সেশনজট অভিশাপ না আর্শীবাদ? | এইচ.এম নুর আলম

এইচ. এম নুর আলম : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের লাইফে ভয়াবহ একটি শব্দ সেশনজট। প্রাইমারি লেভেলে এই শব্দটির সাথে শিক্ষার্থীরা পরিচিত না হলেও কলেজ ও ভার্সিটি লাইফে যে কোনো শিক্ষার্থীর জন্য এই শব্দটি আঁতকে ওঠার মতো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ ২০১৮ সালের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট শুন্য ঘোষণা করলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেশনজট কবে শূন্য হবে তা জানা নেই।

সেশনজট কী এবং কেন হয় এই প্রশ্নটি হয়তো বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জানা। কিন্তু বিদেশে শব্দটি খুবই অপরিচিত। সমকাল এর (অনলাইন ভার্সন) ২৬ নভেম্বর (২০১৫) জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থীর (সেশনজট যেখানে অপরিচিত-শিরোনামে) লিখনী থেকে জানা যায়, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ থেকে পাশ করে জাপানের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে বিড়ম্বনার শিকার হন। সনদে ফলাফল প্রকাশের তারিখ ৩০ জুন, ২০১৪ লেখা থাকায় সন্দেহ প্রকাশ করেন সাক্ষাৎকার নেওয়া এক জাপানী কর্মকর্তা। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে একাডেমিক কোর্স শেষ হওয়ার কথা এবং সেই অনুযায়ী সনদে ফলাফল প্রকাশের তারিখও লেখার কথা । কিন্তু সেশনজটের কারণে ২০১২ থেকে ২০১৪ লেখায় বিস্মিত হয়েছেন তিনি। তিনি নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, এই তারিখ কি সঠিক- না আপনার বিশ্ববিদ্যালয় ভুল করে সনদে তারিখ বসিয়েছে? অর্থাৎ তারা জানেনই না সেশনজটটা কী?

বাংলাদেশে সেশনজট কবে শুরু হয়েছে আর কে শুরু করেছে এটা পরিস্কারভাবে জানা না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জহিরুল হক মজুমদারের বিডিনিউজ টুয়েন্টফোর এর মতামত ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট ও সমাধানের নির্দেশ’ কলামে (৪ জুন, ২০১৫) তিনি লিখেছেন, ‘সেশনজটের শুরু আশির দশকে, স্বৈরশাসনের সময়। তখন স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারের উচ্চ মহলের নির্দেশে অনেকবার বিশ্ববিদ্যালয় অনেকবার বন্ধ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।’

সেশনজটের শুরুটা বিভিন্ন দিক থেকেই হতে পারে। হতে পারে একাডেমিক জটিলতা । আবার প্রশাসনিক জটিলতার কারণেও সেশনজটটা হতে পারে। তবে সাধারণভাবে সেশনজটটকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে। এক. নির্ধারিত বা স্থায়ী সেশনজট, দুই. রাষ্ট্রীয় গোলযোগের কারণে সেশনজট, তিন. অন্ত:কোন্দলজনিত সেশনজট এবং চার. স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ও প্রশাসনের একগুঁয়েমিতা।

নির্ধারিত বা স্থায়ী সেশনজট: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বিধি মোতাবেক প্রতি বছর যে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে এর সাথে প্রতি বছর যে পরিমাণ শিক্ষক অন্যত্র চলে যায় বা শিক্ষাছুটিতে যায় অনেক সময় তার ঘাটতি পূরণ করা হয় না। ফলে নামেমাত্র কোনো বিভাগে কিছু সংখ্যক শিক্ষক থাকলেও শিক্ষাছুটিতে থাকেন অনেকেই।ফলে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে জটটা আরো প্রতি সেমিস্টার ৫-৬%বেড়ে যায়। কারণ, প্রতি বছর নতুন নতুন ব্যাচ সৃষ্টি হয় কিন্তু সংখ্যা বাড়ে না। ফলে স্থায়ী সেশনজটের সৃষ্টি হয়।

রাষ্ট্রীয় গোলযোগের কারণে সেশনজট: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশে বিরাজিত অসহিষ্ণু মনোভাবের কারণে সেশনজ বৃদ্ধি পায়। হরতালের মতো কিছু সহিংস ঘটনায় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকে দীর্ঘদিন। আবার রাষ্ট্রীয় সরকারের কিছু পদক্ষেপের কারণেও মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফুসে উঠে। ফলে অনির্দিষ্টভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সেশনজটের মাত্রা বেড়ে যায়।

অন্ত:কোন্দলজনিত সেশনজট: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানে থাকবে বিভিন্ন মতের, আদর্শের বিভক্তি আর টানাপোড়েন। প্রতিনিয়ত লেগেই আছে এই বিভক্তির প্রলাপ। বিরাজমান দলগুলোর মাঝে সহিষ্ণু মনোভাবের অভাব এবং ক্ষমতার দ্ব›েদ্ব টিকে থাকতে গিয়ে মারামারি,রক্তাক্ত সংঘাত লেগেই থাকে। ফলে বড় ধরণের সহিংস রক্তপাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে সেশনজটের পাল্লা ভারি হয় আরেক দফায়।

স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ও প্রশাসনের একগুঁয়েমিতা: কখনো কখনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা আর কর্মচারিরা তাঁদের দাবি আদায় ও স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে নামেন। দিনের পর দিন আন্দোলন চললে ক্লাস-পরীক্ষা ভাগাড়ে যায়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া ও কখনো কখনো একগুঁয়েমিতার কারণে এ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে সহিংসরুপ নিলে কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও দাবি না মেটানো এবং যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ক্ষোভ থেকে সেটা ভয়াবহ আন্দোলনে রুপ দেয় যার স্বাক্ষী রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

নির্দিষ্ট সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে না পারা: সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্দিষ্ট সময়ে সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে না পারায় খানিকটা সেশনজটের ছোবলে পড়ে শিক্ষার্থীরা। একটি সেমিস্টার ছয় মাসে শেষ করার কথা থাকলেও শেষ হয় ৮/৯ মাসে। কখনো এটার ব্যাপ্তি ১০ মাসেও পৌঁছে। ফলে বারো মাসে বা এক বছরে দুটি সেমিস্টার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দেড় বছর লেগে যায়।

আন্তরিকতা ও একাধিক দায়িত্ব গ্রহণ: উপর্যুক্ত সমস্যাগুলো বিদ্যমান থাকলেও শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাবেও অনেক সময় সেমিস্টার পিছিয়ে যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও কখনো কখনো ৬/৭ টি ক্লাস নিয়েই ক্ষান্ত হন কিছু শিক্ষক। আবার এই ক্লাস শুরু করতেই লাগে ২/৩ মাস। সেমিস্টার পদ্ধতিতে কোনো কোনো শিক্ষক ৬ মাসের শেষের দুই মাস বা একমাসেও ক্লাস নিতে গিয়ে আন্তরিকতার পরিচয় দেন না। এর ফলে পড়াশুনার চাপ বাড়ে। ফলাফল খারাপ করেন শিক্ষার্থীরা। যেখানে মাঝে মাঝে ক্লাস শেষ করতে চার মাসও লাগে না সেখানে ছয় মাসেও সেমিস্টার শেষ না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় ভোগেন শিক্ষার্থীরা। নির্দিষ্ট সময়ের পর সেমিস্টার শেষ হলেও আবার ফলাফল প্রকাশ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়।

আবার একজন শিক্ষকের একাধিক দায়িত্বে থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস ও একাডেমিক কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে পারেন না। ফলে সেক্ষেত্রেও সেশনজটটা বেড়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে সেশনজট বাড়ার অন্যান্য কারণ থাকলেও শিক্ষকদের আন্তরিকতাও একটা বড় কারণ।

দেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে সেশনজটের বোঝা কমে আসতে থাকলেও কমছে না পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। সেশনজট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি), পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দ্রæত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।

সেশনজট কোনোক্রমেই আর্শীবাদ নয় বরং ভয়াবহ অভিশাপ।সেশনজটের ছোবলে শিক্ষার্থীদের জীবনের কয়েকটি বছর হারিয়ে যাচ্ছে অনায়াসে। বাড়ছে দরিদ্র পরিবারের চাপের বোঝা। বাড়ছে কান্না আর দুশ্চিন্তা। নির্দিষ্ট সময়ে অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স শেষ না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকুরিতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। কে জানে কবে শেষ হবে এই ‘সেশনজট’ নামের ভয়ানক কীটের দংশন?

সুতরাং সেশনজট নিরসন করতে হলে উপর্যুক্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেকে সুষ্ঠু সমাধান করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। সু-নজর দিতে হবে রাষ্ট্রকে। সুনাগরিক হতে হলে আর রাষ্ট্রের বোঝা না হয়ে শক্তিতে পরিণত করতে গুণগত শিক্ষার বিকল্প নেই। সুতরাং এর জন্য চাই সেশনজট নিরসনে সংশ্লিষ্ট সকলের কার্যকর পদক্ষেপ।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর।