সোশ্যাল মিডিয়া : বিদেশিদের প্রতারণার অভিনব ফাঁদ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দেশে অবস্থানকারী বিদেশি প্রতারকদের একটি চক্র। এদের সঙ্গে দেশের প্রতারকরা জড়িত থাকলেও বিদেশিরাই বাছাই করা লোকজনকে টার্গেট করে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ শুরু করে। কথোপকথনে (চ্যাটিং) ঘনিষ্ঠ হয়। এরপর নিজের বিপদের কথা বলে সহানুভূতি আদায় করে আর্থিক লেনদেনে প্রলুব্ধ করে।খবর যুগান্তরের।

প্রতারকদের কেউ আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুসম্পর্ক স্থাপনের পর ভালো লাভের ব্যবসায় তাদের সঙ্গে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। এ ফাঁদে পা দিয়ে কেউ টাকা প্রদান করলেই প্রতারণা শেষ হয় না। নানা অজুহাতে প্রতারকচক্র আরও টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। অনেকে আবারও টাকা দেন। এরপর বুঝতে পারেন- প্রতারিত হয়েছেন।

দক্ষিণাঞ্চলের ভোলার চরফ্যাশনের বাসিন্দা মো. কামারুজ্জামান (৫০) পেশায় গ্রাম্য চিকিৎসক ও ওষুধ ব্যবসায়ী। ভাতিজার খুলে দেয়া একটি ফেসবুক আইডি মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেন তিনি। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করে প্রিসকো খলিফা নামে এক বিদেশি তরুণী তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। ফেসবুক বন্ধু হন তারা। শুরু হয় চ্যাটিং।

একপর্যায়ে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাদের মাঝে। এরপর চার মিলিয়ন ডলারের লোভ দেখিয়ে ধাপে ধাপে কামারুজ্জামানের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

এ চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে চাকরি শেষে পাওয়া পেনশনের ৪০ লাখ ৩৮ হাজার টাকা হারিয়েছেন মো. শাহনূর হোসেন (৪০)।

শুধু এ দু’জনের ৬৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা নয়, আরও অনেকেই খুইয়েছেন তাদের সর্বস্ব। ভুক্তভোগীদের অনেকেই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে যোগাযোগ করেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পৃথক চারটি ঘটনায় সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্যরা সম্প্রতি কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গত এক মাসে এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বিদেশি ও দেশি মিলিয়ে ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (উত্তর)। তাদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এ চক্রের প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দেশি-বিদেশি নাগরিকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী প্রতারকচক্র। এ চক্রের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারের মাধ্যমে অবস্থাসম্পন্ন লোকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে।

আলাপের একপর্যায়ে যখন পরস্পরের মধ্যে বিশ্বস্ততা গড়ে ওঠে, তখন মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখায় তারা। আর এ ফাঁদে যারা পা বাড়ান, তাদের নিঃস্ব করে ছাড়ে প্রতারকচক্র।

কর্মকর্তারা জানান, প্রতারকচক্রের হোতা দুই বাংলাদেশি। তাদের গ্রেফতার করা যায়নি। নাইজেরিয়ার নাগরিকসহ এ প্রতারকচক্রের নেটওয়ার্কে রয়েছে মালয়েশিয়া, লন্ডন ও পাকিস্তানি নাগরিক।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, আফ্রিকা, নাইজেরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের তরুণ-তরুণী বাংলাদেশিদের সঙ্গে নিয়ে ভয়ংকর প্রতারকচক্র গড়ে তুলেছে। এ চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। এরপর ফাঁদে ফেলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় তারা।

যেভাবে ফাঁদে পা দেন কামারুজ্জামান : কামারুজ্জামানের সঙ্গে চ্যাটিংয়ের একপর্যায়ে প্রিসকো খলিফা জানায়, সে আফ্রিকার এক রিফিউজি ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ কথা জেনে করুণা হয় কামারুজ্জামানের।

ব্যক্তিগত জীবনের গল্প বলতে গিয়ে প্রিসকো জানায়, তার বাবা মৃত ড. ডেভিড উইলসন খলিফার নামে লন্ডনের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩.৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার জমা আছে। এ টাকা উত্তরাধিকারী হিসেবে উত্তোলন করা এ মুহূর্তে তার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কামারুজ্জামানের কাছে সে সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। যদি কিছু টাকা খরচও হয়, কামারুজ্জামানের পক্ষে সম্ভব হলে তা করতে অনুরোধ করে।

তখন কামারুজ্জামান জানায়, কীভাবে সে লন্ডনের ব্যাংকে যোগাযোগ করবে। প্রিসকো তাকে (কামারুজ্জামানকে) তার মনোনীত বাংলাদেশি ব্যারিস্টার ইব্রাহিম ওসমানের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়।

ব্যারিস্টার ইব্রাহিমের সঙ্গে কামারুজ্জামান ই-মেইলে যোগাযোগ করেন। ইব্রাহিম তাকে লিজা আক্তার নামে একজনের ঢাকার উত্তরা শাখায় সিটি ব্যাংক লিমিটেডের একটি অ্যাকাউন্টে ১ হাজার ২৮০ ইউএস ডলারের সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা জমা দিতে অনুরোধ করেন। কামারুজ্জামান ব্যাংকে টাকা জমা দেন। পরে ইব্রাহিম তার কাছে প্রিসকো খলিফার বাবার রয়েল ব্যাংকে থাকা অর্থ গ্রহণের জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নিসহ কিছু কাগজপত্র পাঠায়।

এরপর ইব্রাহিম জানায়, কামারুজ্জামানের নামে অর্থ ট্রান্সাফার করতে তাকে ব্রিটিশ হাইকোর্টের ফাইনাল ক্লিয়ারেন্স আনতে হবে এবং লন্ডন যাওয়া-আসা ও অন্যান্য খরচ বাবদ বেশকিছু টাকা দিতে হবে।

কামারুজ্জামান ধাপে ধাপে সিটি ব্যাংকের কয়েকটি অ্যাকাউন্ট ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের অ্যাকাউন্টে ২৫ লাখ টাকা জমা দেন। এরপর আবারও নতুন অজুহাতে টাকা দাবি করলে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। ছুটে যান ডিবি কার্যালয়ে। লিজা আক্তারকে ডিবি পুলিশ এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছে।

কামারুজ্জামান বলেন, ব্ল্যাকমেইল করে আমার কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। চার মিলিয়ন ডলালের লোভে টাকা দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছুটা লোভ তো কাজ করেছে।

আরেক ভুক্তভোগী মো. শাহনূর হোসেন বলেন, এ প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়ে জীবনের শেষ সম্বল পেনশনের ৪০ লাখ টাকা হারিয়ে আজ আমি নিঃস্ব। এ ঘটনা আমার পুরো পরিবারকে পথে বসিয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শাহজাহান সাজু বলেন, প্রতারকচক্রের সদস্যরা মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এ চক্রের সঙ্গে আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, লন্ডন ও পাকিস্তানি নাগরিক জড়িত। এ চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। সঙ্গে কিছু মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীও জড়িত।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার গোলাম সাকলায়েন বলেন, এ চক্রের সদস্যরা প্রতারণার সময় ভুক্তভোগীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে না। তারা নানা নামে ফেসবুক, ই-মেইল, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সহজে তাদের গ্রেফতার করতে পারে না।

সহকারী কমিশনার বলেন, এ চক্রের দুই হোতার নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া কে এই ব্যারিস্টার ইব্রাহিম, সেটাও নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।

এ বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, অনেক অবৈধ বিদেশি নাগরিক দেশে নানা অপরাধে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। প্রতারণার সঙ্গে জড়িত এসব অবৈধ নাগরিককে ধরতে শিগগিরই অভিযান পরিচালিত হবে।