সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী মনিরুল যেন টাকার মেশিন!

মনিরুল ইসলাম। বরগুনা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী। ২৭ বছরের চাকরিজীবনে বেতন পেয়েছেন প্রায় ২৫ লাখ টাকা। অথচ রাজধানী ঢাকাসহ নিজ জেলা পটুয়াখালীতে প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য মিলিয়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। এসব করেছেন তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে।

প্রথম জীবনে সওজের একজন সার্ভেয়ার (পরিমাপক) হিসেবে চাকরি শুরু মনিরুলের। এসএসসি পাস করে ২২ বছর চাকরি করলেন ওই পদে। ২০০৮ সালে পদোন্নতি পেয়ে হন উপসহকারী প্রকৌশলী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালে মনিরুল রাজধানী ঢাকার শ্যামলী এলাকার খিলজী সড়কে এক হাজার ২৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন ৭৫ লাখ টাকায়। মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটের (শ্যামলী) বি ব্লকের ২৪/১৪ নম্বর প্লটে একটি ষষ্ঠ তলা ভবনের চতুর্থ তলার এই ফ্ল্যাট। দলিল খরচ কমাতে ফ্ল্যাটটির দাম মাত্র ২৮ লাখ টাকা দেখিয়ে চুক্তিপত্র করেন। এ ছাড়া এলাকায় আরো একটি ফ্ল্যাটসহ ঢাকার মিরপুর বেড়িবাঁধের ইস্টার্ন হাউজিংয়ে নিজ ও স্ত্রীর নামে দুটি প্লট রয়েছে।

নিজ জেলা পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বিলবিলাস বাজারে মনিরুল ও তাঁর স্ত্রীর নামে চারটি প্লট রয়েছে। পটুয়াখালী শহরের বায়োসেফ ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ক্লিনিক এবং সিটিজেন চার্টার ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ক্লিনিকের বড় অংশের মালিক তিনি। পটুয়াখালী শহরে রয়েছে তাঁর একাধিক মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারের ব্যবসা।

মনিরুলের নামে পটুয়াখালী জেলায় চারটি ব্যাংক হিসাব নম্বর পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে বছরের পর বছর ধরে কোটি টাকার লেনদেন করেন তিনি। এর মধ্যে পটুয়াখালীর অগ্রণী ব্যাংকের নিউ মার্কেট শাখার হিসাব নম্বর ৪৮৮৮। উত্তরা ব্যাংকের লঞ্চঘাট শাখার হিসাব নম্বর ৬৭৭৯, কৃষি ব্যাংক বাউফল শাখার হিসাব নম্বর ২৭০০ এবং রূপালী ব্যাংক নিউ টাউন শাখার হিসাব নম্বর ৪০৯৩। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা এবং পটুয়াখালীর বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে নিজ ও স্ত্রীর নামে একাধিক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার নম্বর এখনো জানা যায়নি।

নামে-বেনামে রাজধানী ঢাকাসহ পটুয়াখালীর একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে রয়েছে মনিরুলের হরেক রকমের ব্যবসা। সেসব ব্যবসায় কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সম্প্রতি তেমনি একটি ব্যবসার খোঁজ পাওয়া গেছে। পটুয়াখালী শহরের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কাছে মনিরুল নগদ ৩৩ লাখ টাকা এবং ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার গচ্ছিত রাখেন। ব্যবসায়িক ভাগবাটোয়ারা নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলে টাকা ও স্বর্ণালংকার ফেরত চান। একপর্যায়ে পটুয়াখালী বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মাওলা ও পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মো. শহিদ রেজার মধ্যস্থতায় এ বিষয়ে একটি লিখিত রোয়েদাদের মাধ্যমে আপাত নিষ্পত্তি হয়; যেখানে টাকা এবং স্বর্ণালংকার গচ্ছিত রাখার স্বীকারোক্তি রয়েছে।

বরগুনার সড়ক ও জনপথ বিভাগে দুই দফা চাকরি করেছেন মনিরুল। দ্বিতীয় দফায় দুই বছর ধরে রয়েছেন। এ দুই বছরে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সওজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদাররা জানান, বরগুনা সওজ উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. শামসুল শাহরিয়ার ভুইয়ার সঙ্গে আঁতাত করে দুর্নীতি করছেন মনিরুল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগী একাধিক ঠিকাদার জানান, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ফেরিঘাটে প্যালাসাইডিং কাজ করার জন্য ১১ লাখ ২৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। নামমাত্র কাজ দেখিয়ে ঠিকাদারের যোগসাজশে পুরো টাকা আত্মসাৎ করেন মনিরুল। ফলে সামান্য জোয়ারে কোমর পানিতে ডুবে থাকে ফেরিঘাটের দুইপারের গ্যাংওয়ে। বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল। ভোগান্তির শিকার হয় নারী ও শিশুসহ শত শত যাত্রী।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে বরগুনার-বাইনচটকী ফেরিঘাটের জন্য ৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকার ওয়াররোপ (ইস্পাতের মোটা দড়ি) সরবরাহের কাজ না করে বিল তুলে আত্মসাৎ করেন।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে বরগুনার-বাইনচটকী ফেরিঘাটের জন্য ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং পরে কোটেশনের মাধ্যমে আরো সাত লাখ ৫০ হাজার টাকার ব্যাটস (বড় আকৃতির ইটের খোয়া) সরবরাহের কাজ না করে বিল তুলে আত্মসাৎ করেন।

বরগুনার বড়ইতলা-বাইনচটকী ফেরির ইজারাদার মো. ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘ফেরিঘাটের ইজারা নেওয়ার পর থেকে মনিরুল আমার কাছ থেকে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা চাঁদা নিচ্ছে। ’ তিনি সুনির্দিষ্ট ১৮টি অভিযোগ লিখিত আকারে দিয়েছেন জেলা প্রশাসককে (ডিসি)। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে পটুয়াখালী সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আযম শেখকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, মনিরুলের বাড়ি বাউফল উপজেলার বিলবিলাস গ্রামে। তাঁর বাবা মৃত আব্দুর রশীদ মৃধা কৃষি বিভাগের একজন করণিক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী (শাহিনা রেজভীন) পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দপ্তর সহকারী।

অভিযুক্ত উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অসৎ উদ্দেশ্যে স্থানীয় একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছে। ’

উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. শামসুল শাহরিয়ার ভুইয়া বলেন, ‘মনিরুলের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় শুনেছি। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে, আমাদের কিছুই করার নেই। ’

বরগুনার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক ড. মহা. বশিরুল আলম বলেন, ‘একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগটি সওজ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠিয়েছি। একই সঙ্গে তা দুর্নীতি দমন কমিশনেও পাঠানো হয়েছে। ’

সূত্র : কালের কণ্ঠ