হাসপাতালে ঠাঁই নেই তৃতীয় লিঙ্গের

যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছেন রোগী। গলব্লাডারে পাথরের সমস্যা, দ্রুত অস্ত্রোপচার দরকার তারা। কিন্তু তিনি নারী না পুরুষ, কোন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হবে; তাই নিয়ে চলছে সময়ক্ষেপণ। কারণ ওই রোগী ছিলেন রূপান্তরকামী।

আলোচিত এ ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরের এক সরকারি হাসপাতালে। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, প্রায়ই বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা, রূপান্তরকামীরাও।

এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, চিকিৎসার জন্য তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। সরকারি পরিকাঠামোয় পিজিতে লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচার হলেও, আইনি সমস্যা মোকাবেলায় নেই ‘মেডিকো-লিগ্যাল সেল’।

এতে করে জটিলতা দেখা দিলেও কোনো সমাধান দেখতে পাচ্ছেন না চিকিৎসকরা। তবে ইতোমধ্যেই রোগীদের লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে স্বাস্থ্য ভবনে।

লিঙ্গীয় সমস্যায় স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়াদের একজন রানিগঞ্জের বাসিন্দা, রূপান্তরকামী রানি মজুমদার। ছেলেদের স্কুলে পড়েছেন। সে সময় তার নাম ছিল কল্যাণ, সবাই ছেলে হিসেবেই তাকে জানতো। সপ্তম শ্রেণিতে এক বন্ধুর প্রেমে পড়ে শুরু হয় লুকিয়ে থাকা মেয়ের সত্তা চেহারায় ফুটিয়ে তোলার মানসিক টানাপোড়েন। ২০১৪ সালে স্তন প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার করান রানি। পরের বছর চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন সুন্দর মুখ ও হাসি পাওয়ার জন্য। কিন্তু উল্টা ওই চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট করে দেন বলে রানির অভিযোগ। এতে রানির মুখের আদল অনেকটা বৃদ্ধার মতো হয়ে যায়। ঝুলে যায় চিবুকের চামড়া। এখন বাধ্য হয়ে ওড়নায় মুখ লুকিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে রানিকে।

এদিকে, হাল ছাড়েননি ৪০ ছুঁইছুঁই রানি। কোনোভাবে মুখাকৃতি, দাঁত ঠিক করা যায় সে চেষ্টা করছেন তিনি। এরইমধ্যে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য দফতর, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেন্টাল কাউন্সিল ও ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কোথাও তার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

চিকিৎসক সৃজন মুখোপাধ্যায়ের দাবি, এক বা দু’টি অস্ত্রোপচারেই সব সময়ে চাহিদা মতো মুখের আদল আসে না। পরে ছোটখাটো আরও অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে সেটা তিনি জানাতে পারেননি। একটা অস্ত্রোপচারের পরে রোগীর এত অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন মহলে গেলে পরবর্তী অস্ত্রোপচার কী ভাবে হবে বলে প্রশ্ন তার।

তবে রানির অভিযোগ, তার যান টাকা-পয়সা ছিল সবটা গেছে। আর অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয়। তবে এখন তিনি সুন্দর হাসির জন্য ‘মিরাকল’ ঘটার আশায় আছেন।

শুধু রানিই নন, বাংলাদেশ থেকে আসা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ পিজিতে লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারীতে রূপান্তরিত হন। কিন্তু এরপর তার ত্বকে সমস্যা দেখা দেয়। ফের পিজিতে প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে গেলে তাকে নারী ওয়ার্ডে ভর্তি হতে বলা হয়। কিন্তু কাগজ-কলমে নাম পরিবর্তন না হওয়ায় গিয়াসউদ্দিন নামে নারী ওয়ার্ডে নাম এন্ট্রি করা যায়নি।

এসব সমস্যার সমাধান খুঁজছে স্বাস্থ্য ভবন। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, রাজ্যে রূপান্তরকামীদের কথা ভেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা পাধ্যায়ই প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড তৈরি করেন। তিনি এ বিষয়ে সচেতন। যা করার করবেন বলে মনে করেন প্রতিমন্ত্রী।

রাজ্যের একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জানিয়েছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রূপান্তরকামীদের জন্য মেডিকো-লিগ্যাল বোর্ড না থাকায় এসব জটিলতা তৈরি হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা পেতে সমস্যা হলে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা কোথায় যাবেন, কী করবেন কোনো নির্দেশনা নেই। একাধিক সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তারা মেডিকো-লিগ্যাল বোর্ড তৈরির আবেদন করেছেন। ওই বোর্ডে আইনজীবী এবং সমাজবিদরাও থাকবেন। কিন্তু সেই আবেদনেরে কোনো উত্তর মেলেনি। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব রাজেন্দ্র শুক্ল।

অন্যদিকে, রাজ্য ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডও এ বিষয়ে এখন সরব নয়। বোর্ডের চেয়ারপারসন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, হাসপাতালের ফর্মে নারী-পুরুষের সঙ্গে ‘অন্যান্য’ কথাটিও থাকা দরকার। রূপান্তরকামীদের জন্য মেডিকো-লিগ্যাল সেল থাকাও জরুরি। আইনি অধিকার থাকলে লড়াইয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকা যায়।

তিনি আরও বলেন, পরিচয়ের বিভিন্ন সূক্ষ্ম স্তর থাকে। সাধারণ মানুষ সেটা অনুভব না করলে পরিস্থিতি বদলাবে না।