১৫ বছরের এই মেয়েটি তার নিজের বিয়ে ঠেকাতে পেরেছিল

“আমার অনেকগুলা ভাই-বোনতো, আর্থিক সমস্যা হয়ে যাইতেছিল, পরে আমারে বিয়া দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি বলছি যে, আমার এক জায়গায় বিয়া হইলে তোমরা তো বুঝবা না যে স্বামীটা ভাল। যদি স্বামীটা খারাপ হইলো, আমারে ছাইড়া দিলো, তারপর আমি কী কইরা খাইতাম।… শোনে নাই”।

বলছিল নির্জনা আক্তার মার্জিয়া। মুন্সীগঞ্জের সুখবাসপুর শ্যামনলীনি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীতে পড়ছে সে।

বাবা কথা না শোনায় অবশ্য দমে যায়নি সে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং একজন সাংবাদিকের সাহায্যে স্থানীয় প্রশাসনকে তার বিয়ের কথা জানায় মার্জিয়া। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে থেমে যায় বিয়ে।

“মনে হচ্ছিল বিয়ে হইলে জীবনটা এখানেই শেষ। আমার পড়ালেখা কইরা আরো বড় হইতে হইব”।

অকপটে বলছিল মাত্র ১৫ বছরের এই কিশোরী। আগামী বছর এস এস সি পরীক্ষা দেবে সে।

গত কয়েক বছরের স্কুলজীবনে সে বেশ কয়েকজন সহপাঠীকে বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে স্কুল ছাড়তে দেখেছে।

জিজ্ঞেস করলাম, বান্ধবীদের নিরুপায় হয়ে পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে দেখলেও রুখে দাঁড়ানোর এই সাহস হলো কীভাবে?

“সাহস ছিলো না, ক্যামনে ক্যামনে যেন হয়ে গেছে”- মৃদু হেসে জবাব মার্জিয়ার।
এখন কী মনে হয়, কাজটা কেমন হয়েছে? জানতে চাইলে চেহারা প্রথমে কিছুটা ম্লান হয়, আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

“বাসায় থাকলে মনে হয় ভুল করছি, কিন্তু স্কুলে আসলে সব ঠিক হয়া যায়”।

“ভবিষ্যতের কথা ভাবলে মনে হয় খুব ভালো একটা কাজ করছি”।

মাত্র মাসখানেক আগে বাল্যবিয়ের মুখ থেকে ফিরে আসা মার্জিয়া যে দৃঢ়তা নিয়ে কথাগুলো বলছিল, সেটি হয়তো অনেককেই অবাক করবে।

তবে মার্জিয়ার মত এই সাহস সব মেয়ে দেখাতে পারে না।

মার্জিয়ার বাল্যবিয়ে ঠেকাতে যারা সহায়তা করেছেন তাদের অন্যতম একজন, স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মো. রমজান আলী।

তিনি বলছিলেন, গত বছরেই তার স্কুলের চারটি মেয়ে বাল্যবিবাহের কারণে পড়ালেখা ছেড়েছে। তাদের দুজন দশম শ্রেণীর এবং দুজন পড়ত মাত্র সপ্তম শ্রেণীতে।

“আমাদেরকে জানালে হয়তো আমরা একটা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। যেমন গত রোজার সময়ই মিটিং করে বাল্যবিবাহমুক্ত ইউনিয়ন ঘোষণা করলো। রোজার পরেই দেখি আমার ক্লাস সেভেনের এক মেয়ে আর স্কুলে আসে না, তার বিয়ে হয়া গেছে। ইউনিয়ন পরিষদের কাছেই তার বাড়ি”।

“আমরা বলি যে লেখাপড়ার খরচ সরকার থেকে বা কোন সংস্থা থেকে হোক আমরা দিমু, নাহয় টাকা ছড়াই পড়ামু। তাও মেয়েদের পড়ান। তবুও অনেক গার্জিয়ান আমাদের না জানায়ে গোপনে বিয়া দিয়া দেয়”। আক্ষেপ করে বলেন মি. আলী।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা, ইউনিসেফের হিসেবে, বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ মেয়েরই বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স হবার আগেই। এশিয় দেশগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহের হার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি।

২০২১ সালের মধ্যে এই হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার।

যদিও বাল্যবিবাহ নিরোধে নতুন আইনে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ের সুযোগ থাকায় এনিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে।

স্কুল থেকে কিছুটা দুরে কথা হলো মার্জিয়ার বাবা বশির আহমেদের সাথে।

তিনি বলছিলেন, মেয়ে বড় হবার পর বিভিন্ন দিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসায় তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু পরে ভুল বুঝতে পেরেছেন।

“মাইয়া ডাঙ্গর হইলে মানুষজন প্রস্তাব রাখতেই পারে, প্রস্তাব রাখলেই যে বিয়া দিতে হইব এমন কোন কথা নাই”।

মেয়ের পড়ালেখা শেষ হবার আগে এখন আর বিয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছা নেই বলে জানালেন বশির আহমেদ।

স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করার পর মার্জিয়ার বাবার সাথে কথা বলেন মুন্সিগঞ্জের সহকারী কমিশনার সাঈদুজ্জামান খান।

তিনি বলছিলেন, প্রতি সপ্তাহেই, বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার এধরণের জোর করে বাল্যবিবাহ দেয়ার চেষ্টার খবর আসে তাদের কাছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনও তৎপর। কিন্তু তারপরও গোপনে যেসব বিয়ে দেয়া হয়, তার অনেক খবর হয়তো তাদের কাছে আসেই না।

“খুব গোপনে যদি বিয়ে দেয়া হয় তাহলে আমাদের পক্ষে জানাটা কঠিন। তবে এবিষয়ে আমাদের গণসচেতনতা তৈরির কাজ চলছে। এখন আমরা এমন ইনফরমেশনও পাচ্ছি যে গার্জিয়ানরা যখন জোর করে বিয়ে দিতে চায়, তখন তারাই প্রশাসনকে জানাচ্ছে, গণমাধ্যমকে জানাচ্ছে। এধরণের ঘটনাও ঘটছে”।

১৯২৯ সালের আইন অনুযায়ী বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে প্রশাসন। যেই আইন কিছুদিনের মধ্যেই বদলে যাবে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬ এর মাধ্যমে।

নতুন আইনে অপরাধের সাজা কঠোর করা হলেও, বিধান রাখা হয়েছে বিশেষ প্রেক্ষাপটে মেয়েদের ১৮ কিংবা ছেলেদের ২১ বছরের নীচে বিয়ে দেয়ার।

অস্পষ্টতা রয়েছে এই বিশেষ প্রেক্ষাপট কী হবে তা নিয়ে। নারী অধিকারকর্মীরাসহ অনেকেই আশঙ্কা করছেন, আইনের এই সুযোগ ব্যবহার করে অনেকেই হয়তো নিজের মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেয়ার চেষ্টা করবেন।

২০ বছরের বেশি শিক্ষকতা জীবনে স্কুলের অনেক মেয়েকেই বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে পড়ালেখা ছাড়তে দেখেছেন স্কুলশিক্ষক রমজান আলী, মার্জিয়াও যাদের একজন হতে যাচ্ছিল।

তিনি কী মনে করছেন সরকারের নতুন এই আইন নিয়ে?

“বিশেষ প্রেক্ষাপটটা কী আমি জানি না। কিন্তু ১৮ বছরের নীচে যদি বিয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে তাহলে সব অভিভাবক না হইলেও অনেক অভিভাবক এই সুযোগটা নিতে পারে”। বলেন মি. আলী।

মি. আলী যে বাস্তবতার কথা বলছেন সেদিকে দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে বাল্যবিবাহ রোধে বাংলাদেশকে এখনো অনেকদূর যেতে হবে। নতুন আইন সেখানে কতটা ভূমিকা রাখবে সেটাও এখনো বোঝা কঠিন।

তবে আইনের অস্পষ্টতার কারণে শঙ্কা রয়েই যাচ্ছে, এর ফলে মার্জিয়ার মতো মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে কিনা।-বিবিসি