৪৬ বছর পর হলেন ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা!

লালমনিরহাটের সদর উপজেলার কুলাঘাটা ইউনিয়নের ছেলেবুড়ো সবাই জানেন তিনি একজন স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানের আমলে তিনি ছাত্রলীগে একমাত্র হিন্দু ধর্মালম্বীর পদধারী নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন।

বলছি, মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ গোপাল রায়ের কথা। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর তিনি হয়ে গেলেন ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা! স্থানীয় রাজনৈতিক চক্রান্তের কারণে সম্প্রতি হালনাগাদ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে তার নাম কেটে দেয়া হয়। এখন তিনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা! এ নিয়ে লালমনিরহাটের সর্বত্র সমালোচনার ঝড় বইছে।

এ বিষয়ে লালমনিরহাট সদর উপজেলার ইউএনও শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির আমি একজন সদস্য। তবে তার সব কাগজপত্র সঠিক রয়েছে। এরপরও স্থানীয় রাজনীতির কারণে তিনি চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। এ কারণে তাকে আমি পরামর্শ দিয়েছি যে, বিষয়টি নিয়ে যেন তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে অভিযোগ দেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার তৎকালীন এম এন এ রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ ভোলা মিয়ার প্রত্যয়নপত্র আছে। তৎকালীন সংসদ সদস্য আবুল হোসেনের প্রত্যয়নপত্র রয়েছে তার। পাশাপাশি মুক্তিবার্তায় ০৩১৪০১০০২২ নম্বর সিরিয়ালে তার নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত গেজেট নম্বর-২০০৮ (তারিখ-২৬-১২-২০১১) এবং প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত সনদ নম্বর-২১৮৬৯।

অভিযোগ রয়েছে, লালমনিরহাট জেলায় ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধীতা করায় কৃষ্ণ গোপাল রায়কে বেআইনিভাবে তার মুক্তিযোদ্ধার প্রমাণপত্র চেয়ে পাঠায় লালমনিরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা জেলা কমান্ডার মেজবাহ উদ্দিন আহেমদ। অথচ যেসব মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুক্তিবার্তায় অন্তর্ভুক্ত করা আছে, তাদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়। যথারীতি কৃষ্ণ গোপাল রায় তার মুক্তিযোদ্ধার সকল কাগজপত্র জেলা কমান্ডারের কাছে জমা দেন। পরবর্তীতে তার নাম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কৃষ্ণ গোপাল ৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৭ এপ্রিল রংপুরের ১২ জন ছাত্র নেতার সঙ্গে লালমনিরহাট সীমান্ত পার হয়ে ভারতের কুচবিহারের দিনাহাটা এলাকায় যান। সেখানে তৎকালীর ফরোয়ার্ড ব্লকের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী কমল গুহের নির্দেশনায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। বৃহত্তর রংপুর এলাকা থেকে তিনি কিশোর ও যুবকদের সংগ্রহ করে ভারতের কুচবিহারের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যেতেন। এই স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে গত মার্চ মাসে লালমনিরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মন্তব্য করেছে।

টেলিফোনে কৃষ্ণ গোপাল রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর তিনি ১৯৭৩ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে তার সঙ্গে যারা বিসিএস কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দিয়েছেন, তাদের প্রায় সকলের একে একে পদোন্নতি হয়। কিন্তু তার পদোন্নতি দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয় শুধু মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে। সর্বশেষ জোট সরকারের আমলে ২০০৬ সালে সংস্থাপন মন্ত্রনালয় থেকে তাকে যুগ্মসচিব হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস যে, আমাকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।